ফ্যাসিবাদি আমলে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের টপ লিস্টে যারা ছিলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার তাদের অনেকের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, বাকিদেরকে আপাতত সরিয়ে দেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে। তবে ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রশাসনকে নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে সাজিয়েছে, সেই সেট আপ ভেঙে জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব ও গতিশীল করতে প্রশাসনে আরো সংস্কার দরকার হবে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।
এই সংস্কার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত পাঁচজন সচিব বা সমপদমর্যাদার এবং একজন গ্রেড-১ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। এই কর্মকর্তারা হলেন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব) কাজী এনামুল হাসান, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব) সুকেশ কুমার সরকার, ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) মুহম্মদ ইব্রাহিম, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব) মো. সহিদ উল্যাহ এবং ওএসডি সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) লিপিকা ভদ্রকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র দৈনিক দেশবার্তাকে জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে ফেলেছিলো। বিষয়টা এখন এমন নয় যে, সচিব বা অতিরিক্ত সচিবকে সরিয়ে দিলেই প্রশাসন রাহুমুক্ত হবে। সচিব থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যন্ত এমনভাবে কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে, প্রথম স্তর থেকে আওয়ামীপন্থীদের সরিয়ে দিলেও ঠিক ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না, পরের স্তরগুলোতে তারা ঠিকই রয়ে যাচ্ছিলো। অন্যদিকে আওয়ামীপন্থী না হওয়ার অপরাধে সিনিয়র ও মেধাবী কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে প্রশাসনে ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা হয়েছিলো।
এই কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত যে রদবদলগুলো করা হয়েছে সচিব থেকে উপসচিব পর্যন্ত, তাতে করে প্রশাসনের দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তারা ফ্রন্ট লাইনে চলে এসেছেন। পদোন্নতিবঞ্চিতদের কয়েকজনকে এখনও মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি, তবে শিগগিরই তারা যথাযোগ্য মর্যাদা পাবেন। আর ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের কেউ কেউ এখনো রয়ে গেছে, তাদেরও যথাযথ প্রক্রিয়ায় চাকুরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ফোকাস করা হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচকে। গত মার্চে উপসচিব ও সমপর্যায়ের ১৯৬ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এই পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিসিএস ২৪তম ব্যাচ প্রাধান্য পেয়েছে। এর আগে বাদপড়া অন্যান্য ব্যাচের কয়েকজন ইতোমধ্যে পদোন্নতি পেয়েছেন। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ১৯৬ জনের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা ১৪৫ জন।
এবার যারা পদোন্নতি পাননি, তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন। যারা জেলা প্রশাসক ছিলেন কিংবা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের একান্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন; তাদের বেশিরভাগই পদোন্নতি পাননি।
পদোন্নতি না পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাপারে সরকার কী ভাবছে? জানতে চাইলে একজন সচিব দৈনিক দেশবার্তাকে বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গত তিন জাতীয় নির্বাচনে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যারা ডিসি ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই এখন অতিরিক্ত সচিব। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী ডিসিদের প্রায় সবাই এখন যুগ্মসচিব। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় যারা ডিসি পদে ছিলেন, তারা এখনও উপসচিবই রয়েছেন।
তিনি জানান, এই তিন নির্বাচনে অতি উৎসাহী যেসব কর্মকর্তা সক্রিয় ছিলেন, তাদের অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। বাকিদের ক্ষেত্রেও তাই হওয়া স্বাভাবিক।
মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, মার্চে দেওয়া পদোন্নতিতে যে সব উপসচিব স্থান পাননি, তাদের অনেককে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পার হয়ে গেছে, তাদের ফোর্স রিটায়ারমেন্টে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চলতি মাসের শেষ দিকে বা আগামী মাসের শুরুতে সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে বেশ কয়েকটি পদোন্নতি ও রদবদল হতে যাচ্ছে, এমন আভাস দিয়েছেন জনপ্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। এর পাশাপাশি আরো কজন সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়ে আছে।