সাশ্রয়ী ভাড়ায় দীর্ঘ দূরত্বে আরামদায়ক যাত্রার জন্য পরিচিত বাংলাদেশ রেলওয়ে এখনো ব্যাপক আর্থিক ঘাটতির মধ্যে রয়েছে, যা এর কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
প্রতিদিন প্রায় ৩৫০টি ট্রেন—ইন্টারসিটি, লোকাল ও মালবাহী—দেশব্যাপী চলাচল করে এবং বছরে মোট ৮০–৯০ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহন করে।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকসান ছিল ১,৪০০ কোটি টাকারও বেশি। দুর্বল ব্যবস্থাপনা, খারাপ রাজস্ব আহরণ, প্রাচীন মালবাহী অপারেশন এবং আধুনিকায়নের ধীর গতি হচ্ছে লোকসানের মূল কারণ।
যাত্রী পরিবহনই রেলওয়ের মূল ব্যবসা; অধিকাংশ আয় টিকিট বিক্রয় থেকে আসে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কমার্শিয়ালি লাভজনক মালবাহী সেবায় সীমিত বিনিয়োগ রেলওয়ের আয় বৃদ্ধিতে বাধা দিচ্ছে।
কমলাপুর স্টেশনে কথা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যবসায়ী মাসুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাসের তুলনায় দূরপাল্লার যাত্রায় ট্রেন বেশি আরামদায়ক, কিন্তু টিকিট পাওয়া কঠিন। আবার মাঝে মাঝে ট্রেন বিলম্ব হয়ে থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিটি টিকিটে প্রায় ৪০–৫০ শতাংশ সরকারি ভর্তুকি থাকে। কর্মী সংকট, পুরনো ইঞ্জিন ও কোচ, দুর্বল সিগন্যালিং ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে কার্যক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
রেলসূত্র জানায়, ঢাকা–চট্টগ্রাম ও পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ঢাকা–খুলনা রুটে ট্রেন সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেড়ে যাবে।
ভারত, চীন ও ইউরোপের মতো দেশে মালবাহী সেবা বাড়িয়ে রেলওয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও একই রকম পদক্ষেপ চালালে লোকসান হ্রাস ও আর্থিক ভারসাম্য উন্নতি হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যথাযথ পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রেলওয়েকে টেকসই ও আর্থিকভাবে সুসংগঠিত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
বন্দর, সড়ক ও রেলওয়ে রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শহিদ মিয়া বলেন, খারাপ পরিকল্পনাই রেলওয়েকে মুনাফা করতে দিচ্ছে না। জনপ্রিয় রুটে যেমন ঢাকা–ময়মনসিংহ ও ঢাকা–জামালপুরে যথাযথ ট্রেন সংখ্যা নেই, অথচ কম ব্যবহৃত রুটে অতিরিক্ত ট্রেন রয়েছে, যা খরচ বাড়িয়ে দেয় কিন্তু আয় বৃদ্ধি করে না।
শিপিং ও যোগাযোগ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি অশীষ কুমার দে বলেন, অপর্যাপ্ত কার্গো পরিবহন আর্থিক লোকসানে বড় ভূমিকা রাখছে। অপারেশনাল দুর্বলতাই আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ঢাকা ছেড়ে আসা ইন্টারসিটি ট্রেনে এবং শনিবার–রবিবার ফিরতি ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ যোগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে যাত্রী সংখ্যা ও আয় বাড়ে।
একজন সিনিয়র রেল কর্মকর্তা জানান, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট একটি প্রধান আর্থিক বোঝা। এটি অপারেশনাল বাজেট থেকে সরাসরি পেমেন্ট হয়, যেখানে অন্যান্য সরকারি বিভাগে আলাদা কল্যাণ তহবিল থেকে পেনশন দেওয়া হয়।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে রেলওয়ে অবসর বেনিফিটে ব্যয় করেছে প্রায় ৯৪৬ কোটি টাকা; ২০২৪–২৫ সালে এই খরচ প্রায় ১,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
সেই কর্মকর্তার মতে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে রেলওয়ের রাজস্ব ছিল ১,৯২৫ কোটি টাকা; ২০২৪–২৫ এ তা কমে প্রায় ১,৮০০ কোটি টাকায় নেমেছে—গত বছরের জুলাই–আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রায় ছয় সপ্তাহ রেল চলাচল বন্ধ থাকায় এ পতন ঘটে।
শ্রমিক সংকটও রেলওয়ের কর্মদক্ষতায় প্রভাব ফেলছে। অনুমোদিত ৪৭,০০০ পদে শুন্য রয়েছে প্রায় ২৪,০০০। আরও কর্মী রেখে সেবার মান উন্নয়ন ও গন্তব্যে সম্প্রসারণ করলে, যাত্রীসংখ্যা বাড়ে এবং রাজস্ব বৃদ্ধি হতে পারে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন জানান, চলমান খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়েছে; অপরিবর্তিত ভাড়া থাকার কারণে ভর্তুকি প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। মালবাহী পরিবহণ লাভজনক হলেও এর ভলিউম কমেছে। তবে একটি সার্ভিস প্রোফাইল প্রতিষ্ঠান হিসেবেই রেলযাত্রার সেবা-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়, লাভ এখানে প্রথম লক্ষ্য নয়।