আজ ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ, চা শ্রমিক নেতা কমরেড মফিজ আলীর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই মহান নেতা ২০০৮ সালের ৩০শে আগষ্ট কুলাউড়ার একটি কৃষক সভা থেকে ফেরার পথে নিজ বাড়ির সম্মুখে দুর্ঘটনাকবলিত হন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ২০০৮ সনের ১০ অক্টোবর ভোর রাতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৮১ বছর। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ধূপাটিলায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মফিজ আলীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এনডিএফ এর জেলা সভাপতি এবং শক্তিশালী কবি শহীদ সাগ্নিক। তিনিও আজ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে আছেন। তারপরও ভুলে যাননি মফিজ আলীকে।
মফিজ আলীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'মফিজ আলী আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। তার জীবনে অনেক লোক এসেছিলো কেউ শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। শমশেরনগরের মনোহর আলী আর আমি এককভাবে ছিলাম। প্রতিবছরই আমি তার মৃত্যুবার্ষিকীতে উপস্থিত থাকতাম, এই বছর আমার শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় উপস্থিত থাকতে না পারাটা হবে আমার জন্য পীড়াদায়ক।'
কমরেড মফিজ আলী ছিলেন এক ত্যাগী জননেতা। ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রামের নাম ছিল শ্রীসূর্য ধোপাটিলা। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ, চা শ্রমিক নেতা ও লেখক।
তাঁর জীবন ছিল কৃষক-শ্রমিক মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত। তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানীর স্বার্থক উত্তরসুরী। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ছিল সীমাহীন। শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেছেন। ৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি বালিশিরাসহ বহু কৃষক আন্দোলন ও চা শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
দীর্ঘদিন রাজবন্দী হিসেবে জেলও খেটেছেন। যতবারই তিনি জেলে গিয়েছেন, ততবারই তার সমর্থকরা 'মফিজ আলীর মুক্তিচাই' স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলতেন জেলা সদরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের এলাকাসমূহকে। এমনকি রাজধানী ঢাকার রাজপথও কাঁপিয়ে তুলতেন তার ভক্ত সমর্থকরা। এলাকার মানুষ জানতেন, বারবার তিনি স্বৈরাচার সরকার সমূহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবেন, বারবার বন্দী হয়ে জেলে যাবেন এবং বারবার আমজনতা আন্দোলন করে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে আসবেন।
ষাটের দশকের সেই উত্তাল সময়ে লৌহমানব স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কেউ যেখানে প্রতিবাদ করার সামান্য সাহসটুকু অর্জন করতে পারেননি, সেখানে এই হালকা-পাতলা গড়নের মানুষটি আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রীতিমতো হুংকার ছেড়েছিলেন।
জননেতা মফিজ আলী ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯-এর গণআন্দোলন, বালিশিরাসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন, চা শ্রমিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ইত্তেফাক, সংবাদ, সাপ্তাহিক জনতা, লাল বার্তা ও ইংরেজী ডন পত্রিকায় একাধারে লেখক-সাংবাদিক হিসাবে লেখালেখি করতেন। শিক্ষকতা পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি তাঁর জীবনের পুরোটা সময় নিজের পরিবার-পরিজন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা না করে সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৫৪, ১৯৬০, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭২ সালে রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন মামলায় তিনি দীর্ঘ ৬ বছর রাজবন্দী হিসাবে কারাবরন করেন।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।
জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সব্যসাচী লেখক ও সাংবাদিক মীর লিয়াকত আলী এই কিংবদন্তিতুল্য মানুষটি যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়ায় রীতিমতো হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছেন, 'মাওলানা ভাসানীর স্বার্থক উত্তরসুরী ভাষাসৈনিক মফিজ আলী সিলেট অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ একজন মানবসেবক। কৃষক শ্রমিক ভুখনাঙ্গা মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ছিলো সীমাহীন! প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন সার্বজনীন, বিশেষত চা-জনতা ও দুখী মানুষের স্বজন!
তিনি রাজনীতি, সমাজনীতি, শুদ্ধনীতি, মানবাধিকারের একজন সফল শিক্ষক। 'ধুৃপাটিলার মফিজ আলীর মুক্তিচাই' এই শ্লোগানটি রাজধানী ঢাকায় হয়েছে আয়ুবশাহীর জ্বলন্ত শাসনামলে। মুক্তির পর ফুলের মালা দিয়ে বরন করেছিলো সমগ্র শমশেরনগর। রেলস্টেশন থেকে ধুপাটিলা পর্যন্ত বহুলাংশ লোকে লোকারন্য ছিলো। স্বচক্ষে কি দেখেছেন কেউ? দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার, তাই আমার অনুভুতিটিও অন্যরকম মাধুর্য- মন্ডিত!
মফিজ আলী কি 'চিজ' ছিলেন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলো তৎকালীন খাকি সরকার। সব সময় তাই আইয়ুবীয় বিপদজনক 'ফেউ' তাঁর পিছে লেগে থাকতো, আবার তাঁকে সমীহও করতো! প্রাদেশিক নয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্বের আহ্বান পেয়েছিলেন একাধিকবার, যাননি। সে অনেক কথা, অন্য কোনো সময়ে হবে। যাক সে কথা। এখন শুধু একটি কথা।
যে রাস্তাটিতে লক্ষ বার চলাচল করেছেন অন্তত সেই রাস্তাটির আংশিক নামকরণ তাঁর নামে করার কার্পন্য থেকে এখনো আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না কেন?। আমরা কি এমনই নিমকহারাম? নতুন প্রজন্মও এই দায় এড়াতে পারে না। এই মৃত্যুবার্ষিকীতে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেয়ার আন্তরিক আহ্বান জানাই!
কোনো বিশেষণের দরকার নেই, একটা বোর্ড নিয়ে কেউ এটা করতে পারেন না! 'মফিজ আলী সড়ক'! যে খরচ হবে, অনুমতি দিলে আমি করতে চাই। কাল ১০ তারিখেই এ কাজটা কেউ করবেন? পরের কথা পরে। নিয়ম পদ্ধতি? তা তো মানুষই ঠিক করে। কেউ কি আছেন কাজটা শুরু করার?'
মীর লিয়াকত আলীর এই আক্ষেপটা উপলব্ধি করতে পারবেন তারা, যারা মফিজ আলীর জীবন সংগ্রামের ইতিহাস সম্বন্ধে সামান্যতম জ্ঞান রাখেন। অকুতোভয় এই সাহসী মানুষটি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়েছেন। তিনি তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বের আহ্বানও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু ছিলেন কমরেড অজয় ভট্টাচার্য্য। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা করতেন। তাঁর লেখা প্রথম বই ছিল "পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নমুনা"।
মফিজ আলী ছাত্র জীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্রআন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করে তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ৬০-এর দশকে সংশোধনবাদী তিন শান্তির তত্ত্ব নিয়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক শুরু হলে আমাদের দেশে কমরেড আবদুল হক, কমরেড অজয় ভট্টাচার্য্য প্রমূখ নেতৃবৃন্দ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরে মতাদর্শগত লড়াই চালান।
ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে মফিজ আলী মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি মাঠের কর্মী হিসেবে, জননেতা হিসেবে শোষিত নির্যাতিত শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যেমন নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন, তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। দীর্ঘ ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ৭ বার কারবরণ করেন।
কমরেড মফিজ আলী তাঁর নির্দোষ জীবনযাপন ও আদর্শের জন্য আজও স্মরণীয়।
দেশবার্তা/এসএ/এসবি