দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে এক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে পরাজিত করে ভারত আবারও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এবারের ফাইনাল ম্যাচটি ছিল টানটান উত্তেজনায় ভরা। ভারত টসে জিতে ফিল্ডিং বেছে নেওয়ার পর পাকিস্তানের শুরুটা ছিল দারুণ। কিন্তু মাঝের ওভারগুলোতে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং ধসের শিকার হয় তারা। জবাবে ভারতও শুরুতে উইকেট হারালেও, তিলক বর্মা ও শিবম দুবের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে নবমবারের মতো এশিয়ার সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এই ঐতিহাসিক জয় দুই দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানের ইনিংস: দারুণ শুরু, অবিশ্বাস্য ব্যাটিং ধস
ভারতের আমন্ত্রণে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তানের দুই ওপেনার সাহিবজাদা ফারহান ও ফখর জামান দলকে দুর্দান্ত সূচনা এনে দেন। তাঁরা কোনো উইকেট না হারিয়ে পাওয়ার প্লে পার করেন এবং দলীয় ৫০ রানের কোটা পার করেন। এবারের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের উদ্বোধনী জুটিতে এটাই ছিল সর্বোচ্চ রান। ফারহান ভারতের বোলারদের উপর চড়াও হয়ে বুমরাকে চার ও ছক্কা হাঁকান, যা ইনিংসকে গতি দেয়।
ফারহান আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিয়ারের পঞ্চম ফিফটি পূরণ করেন এবং এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় অর্ধশতকটি করেন। মনে হচ্ছিল পাকিস্তান ২০০ রানের লক্ষ্য দেবে। কিন্তু ইনিংসের দশম ওভারে এসে বরুণ চক্রবর্তীর বলে ৫৭ রান করে ফারহান আউট হতেই পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপে ছন্দপতন ঘটে। অবশেষে ৮৭ রানে ভাঙে এই উদ্বোধনী জুটি।
এরপর সাইম আইয়ুব ১৪ রানে এবং মোহাম্মদ হারিস শূন্য রানে আউট হলে রানের গতি কমে আসে। অন্যদিকে, ফখর জামানও ফিফটির কাছে এসে ৪৬ রানে বরুণ চক্রবর্তীর শিকার হন। ১১৩/১ থেকে ১৩৩/৬-এ পরিণত হয় পাকিস্তান। অধিনায়ক আগা সালমান ও হুসেইন তালাতও দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফেরেন। শেষ আট ব্যাটসম্যানের মধ্যে কেউই দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পারেননি।
ভারতীয় বোলারদের মধ্যে কুলদীপ যাদব ছিলেন সবচেয়ে সফল, তিনি মাত্র ৩০ রানে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নেন। এছাড়া যশপ্রীত বুমরা, অক্ষর প্যাটেল ও বরুণ চক্রবর্তী প্রত্যেকে ২টি করে উইকেট নিয়ে পাকিস্তানকে দিশাহীন করে তোলেন। অবিশ্বাস্য ব্যাটিং ধসের শিকার হয়ে পাকিস্তান ৫ বল বাকি থাকতেই মাত্র ১৪৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। শেষ ৯ উইকেট তারা হারায় মাত্র ৩৩ রানে! নবমবারের মতো শিরোপা জিততে ভারতের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৪৭ রান।
ভারতের ইনিংস: শুরুর ধাক্কা সামলে তিলক-দুবের জয়
১৪৭ রানের সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ভারতের শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা অভিষেক শর্মা দ্বিতীয় ওভারেই ফাহিম আশরাফের স্লোয়ার বলে বোকা বনে গিয়ে ১১১ কিমি/ঘণ্টা গতির কাটারে রউফের হাতে ধরা পড়েন। এরপর অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবও আফ্রিদির স্লোয়ার বলে মাত্র শূন্য রানে আউট হন। এই ধাক্কার পর শুবমান গিলও আশরাফের কাটারে রউফের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলে মাত্র ২০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে ভারত। পাওয়ার প্লে-তে পাকিস্তানের পেসাররা দাপট দেখায়।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরেন তরুণ ব্যাটসম্যান তিলক বর্মা ও উইকেটরক্ষক সঞ্জু স্যামসন। স্পিনারদের সামলে তাঁরা ধীরে ধীরে জুটি গড়ার চেষ্টা করেন। স্যামসন একবার আবরারের বলে 'জীবন' পেলেও সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি এবং ৪২ বলে ৬৯ রানের প্রয়োজন থাকার সময় আবরার আহমেদের শিকার হন।
স্যামসন আউট হওয়ার পর ক্রিজে নামেন শিবম দুবে। পঞ্চম উইকেটে তিলক-দুবের অবিচ্ছিন্ন ৫৩ রানের জুটি ভারতকে জয়ের পথে নিয়ে যায়। হারিস রউফকে 'বেদম পিটুনি' দিয়ে এই জুটি রান রেট আয়ত্তে আনে। রউফের ওভারে দুবে একটি চার মারেন এবং তিলক চার ও ছক্কা হাঁকিয়ে দলীয় স্কোর ১০০-তে নিয়ে যান। তীব্র চাপের মধ্যেও দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে তিলক বর্মা ফিফটি পূরণ করে পাকিস্তানকে চাপে ফেলেন। শেষ ওভারে ভারতের জয়ের জন্য যখন ১০ রান দরকার, তখন ছক্কা মারতে গিয়ে ফাহিম আশরাফের বলে আউট হন শিবম দুবে। তবে ততক্ষণে ভারত জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। শেষ পর্যন্ত ভারত নির্ধারিত ১৯.১ ওভারে জয় তুলে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।
ভারত ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে আরও একবার নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করল
এবারের এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচে ভারতের বিজয় ছিল তাদের দৃঢ়তা এবং গভীর ব্যাটিং অর্ডারের প্রতিফলন। মাত্র ১৪৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে ৩ উইকেট হারানোর পরও তিলক বর্মা ও শিবম দুবে যেভাবে চাপ সামলে দলকে জিতিয়েছেন, তা ভবিষ্যতের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিলক ভার্মার চাপের মুখে ফিফটি এবং শিবম দুবের কার্যকর ইনিংস ছিল ভারতের জয়ের মূল ভিত্তি।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের ইনিংসে সাহিবজাদা ফারহান ও ফখর জামানের দৃঢ় সূচনা থাকলেও মাঝের ওভারে তাদের ব্যাটিংয়ের ধস ছিল হতাশাজনক। ভারতীয় বোলারদের মধ্যে কুলদীপ যাদব তার বৈচিত্র্য এবং নিয়ন্ত্রিত বোলিং দিয়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং মেরুদণ্ড ভেঙে দেন, যার ফলে পাকিস্তান বড় স্কোর করতে পারেনি।
এই জয় ভারতকে নবমবারের মতো এশিয়ার সেরা দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করল এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দলের মনোবলকে আরও বাড়িয়ে দিল। এই ধরনের হাই-প্রোফাইল ম্যাচে তরুণ খেলোয়াড়দের পারফর্ম্যান্স প্রমাণ করে ভারতের রিজার্ভ বেঞ্চ কতটা শক্তিশালী। এই জয়ের মাধ্যমে ভারত ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে আরও একবার নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করল।
দেশবার্তা/এসএ/এসবি